ক্যালিগ্রাফি ছাড়া যখন বাজার থেকে কেনা যেত না চাল-ডাল!

এখন যেমন আমরা কাগজের টাকা ব্যবহার করি, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে এমন টাকার কথা চিন্তাও করা যেত না। টাকা হবে স্বর্ণ বা রুপার, নিদেনপক্ষে তামার। টাকা আবার কাগজের হয় নাকি, তার বুঝি কোনো মানসম্মান নাই!

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আগমনের সময় আরবদেশে পারস্য ও রোমানদের টাকা ব্যবহৃত হতো। তাদের নিজস্ব কোনো মুদ্রা ছিল না। হযরত ওমর (রা)-এর আমলে গোটা পারস্য ও রোমানদের এক বড় অংশ মুসলিমদের অধীনে আসে। তখনও তাদের মুদ্রাই ব্যবহার করা হতো। চার খলিফার শাসনের পর ক্ষমতা হাতে পায় উমাইয়া বংশীয়রা। এই বংশেই কুখ্যাত শাসক এজিদ বিন মুয়াবিয়ার জন্ম, যে কিনা আল্লাহর রসুল (স)-এর প্রাণপ্রিয় নাতি হযরত হুসাইন (রা)-কে শহিদ করে। উমাইয়ারা ছিল খুবই দুনিয়ালোভী আর নিষ্ঠুর শাসক, দু-চারজন বাদে তাদের কারও মধ্যেই ইসলামি মনমানসিকতা ছিল না। তখনকার দিনে নিয়ম ছিল অমুসলিমরা ট্যাক্স দিবে, আর মুসলমানদের ট্যাক্স মওকুফ। রাজ্যে যদি অমুসলিম বেশি থাকে তাহলে ট্যাক্সও বেশি পাবে—এই কারণে তারা জনগণকে ইসলাম গ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত করত, এমনকি মুসলমান হতে বাধা দিত। পরে ওমর বিন আবদুল আজিজ নামক একজন সৎ শাসক এই নিয়ম বাতিল করেন।

উমাইয়া শাসকদের একজন ছিল আবদুল মালেক বিন মারওয়ান (শাসন : ৬১৫ – ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দ)। সে আর দশজনের মতো জঘন্য প্রকৃতির হলেও ছিল শিল্পপ্রেমী। তার হুকুমেই ফিলিস্তিনের কুব্বাত আস সাখরা (ডোম অব দ্য রক) নির্মিত হয়। সে-ই প্রথম মুদ্রার নকশায় পরিবর্তন আনে। সে দুই ধরনের মুদ্রা বানায়, এর মধ্যে স্বর্ণমুদ্রাকে বলা হতো দিনার ও রৌপ্যমুদ্রাকে বলা হতো দিরহাম।

এর পেছনে একটি ইতিহাস আছে। রোমানদের কাছ থেকে এনে মুসলমানরা যে মুদ্রা ব্যবহার করত, তাতে মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে কালেমা ও হযরত মুহাম্মদ (স)-এর লেখা হতো। রোমসম্রাট যখন এই বিষয়ে জানতে পারে, তখন আবদুল মালেক বিন মারওয়ানের কাছে চিঠি লিখে জানায় :

আপনি আমাদের মুদ্রায় হস্তাক্ষরে আপনার নবীর নাম লেখার প্রথা বর্জন করুন, নয়তো দিনারে আমি এমন কিছু লিখব, যা আপনারা সহ্য করতে পারবেন না। কারণ আপনাদের কাজে আমরা কষ্ট পাচ্ছি।

৬৯১-৬৯২ সালে রোমসম্রাট যিশুখ্রিষ্টের ছবি সংবলিত স্বর্ণমুদ্রা বের করে। মুসলিমরা তখন দ্বিধায় পড়ে যায়। আবদুল মালেক বিন মারওয়ান তখন খালিক বিন ইয়াযিদ বিন মুয়বিয়াকে পরামর্শের জন্য ডাকে। সে সব শুনে বলল, আপনার সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টানদের মুদ্রা প্রবেশের পথ বন্ধ করে দিন, নিজে মুদ্রার প্রবর্তন করুন আর মুদ্রায় হস্তাক্ষরের পরিবর্তে লিখাগুলো খোদাই করে দিন। তার কথা মোতাবেক ৬৯৩ সালে খলিফা আবদুল মালেক নতুন একটি দিনার চালু করে। যেখানে আলখাল্লা পরে তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা তার নিজের প্রতিকৃতি যুক্ত করা হয়। চারপাশে আরবি হরফে লেখা হয় কালেমায়ে তাইয়েবা। কিন্তু ইসলামে জীবজন্তুর ছবি নিষিদ্ধ, তার এই মুদ্রা মুসলিমজাহানে বিদ্রোহের সম্ভাবনা তৈরি করে।

৬৯৬-৬৯৭ সালে প্রতিকৃতি ও অলংকরণ বাদ দিয়ে নতুন মুদ্রা চালু করা হয়। এর একপাশে আরবি ক্যালিগ্রাফিতে قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ (কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ), আরেকপাশে করেন আর অপর দিকে لا اله الا الله (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) খোদাই করা হয়। দিনারের চারপাশে রুপার একটি বৃত্ত ছিল। এ বৃত্তের উপরে টাঁকশাল ও শহরের নাম, আর বৃত্তের বাইরের দিকে محمد الر سول الله ارسله بالهدى ودين الحق (মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ, আরসালাহু বিল হুদা ওয়া দীনিল হাক্কি) লেখা ছিল।

মুদ্রাটি চালু করে আবদুল মালেক বিন মারওয়ান ফরমান জারি করে যে উমাইয়া সাম্রাজ্যে এই মুদ্রাই ব্যবহৃত হবে এবং অন্যান্য সব মুদ্রা রাজকোষে জমা দিতে হবে। সেগুলো গলিয়ে মুদ্রা বানানো হয়, আর যারা এই আদেশ অমান্য করেছিল তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এভাবে ক্যালিগ্রাফি সংবলিত স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা হয়ে যায় মুসলিম শাসিত অঞ্চলের একমাত্র মুদ্রা। পরবর্তীতে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, আরবি লেখায় পরিবর্তন এসেছে কিন্তু মুদ্রার নকশা থেকে ক্যালিগ্রাফি বাদ দেওয়া হয় নাই। এরই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, সেই আমলে ক্যালিগ্রাফি ছাড়া কেনা যেত না চাল-ডাল!


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *